ঢাকা শনিবার, ১১ মে, ২০২৪

অব্যবস্থাপনায় ব্যাংক, বাজার ও জ্বালানি

বার্তাজগৎ২৪ ডেস্ক

প্রকাশিত: মার্চ ২৪, ২০২৪

অব্যবস্থাপনায় ব্যাংক, বাজার ও জ্বালানি

প্রথমে কথা হবে বাজার নিয়ে। কারণ দেশের যে কাউকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, আমাদের প্রধান ও সর্বজনীন আলোচনার বিষয় এখন কী, নিঃসন্দেহে জবাব পাওয়া যাবে বাজার। শুধু আলোচনার বিষয় না। বাজার এখন সর্বসাধারণের সমালোচনা, চিন্তা ও দুশ্চিন্তা সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু। বাজারকে ঘিরেই আমরা ঘুরপাক খাচ্ছি। খেতে বাধ্য হচ্ছি। যেন সর্বক্ষণ বাজারের মধ্যেই আমরা আছি। এখন যেন আর শুধু বাজার আমাদের নয়। আমরাও বাজারের।


কথা কেবলমাত্র সাধারণ মানুষকে নিয়ে নয়। সরকারকেও সর্বক্ষণ ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছে বাজার। প্রতিদিনই সরকারের সামনে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসছে বাজার। আজ ডিম তো কাল কাঁচা মরিচ। পরশু শাকসবজি তো পরদিন মাছ-মাংস। তার পরদিন আদা-পেঁয়াজ। বাজারের ওপর দিয়ে যেন প্রতিনিয়ত বয়ে চলেছে এক পাগলা হাওয়া। সেই হাওয়া এলোমেলো করে দিচ্ছে সব। তার পেছনে ছুটতে গিয়ে মানুষ হয়রান। সরকারও গলদঘর্ম।


হবে নাই-বা কেন! বাজার তো কোনো সাধারণ তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার বিষয় নয়। বাজার মানে খাদ্যপানীয়। বাজার মানে বস্ত্র। বাজার মানে মানুষের জীবনযাপনের সব উপকরণ। প্রকারান্তরে মানুষের জীবন ধারণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতম সম্পর্ক বাজারের। সে জন্যই বাজার এত গুরুত্বপূর্ণ। সেই বাজার যখন টালমাটাল হয়ে ওঠে, তখন তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া পুরো সমাজকেই অস্থির করে তোলে।


দীর্ঘদিন এই অস্থির পরিস্থিতির পর সম্প্রতি যখন বাজারে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রবণতা দেখা দিয়েছে, তখনই আবার খবর হয়ে সামনে এসেছে চাল। চালের দামে ঊর্ধ্বগতি। সঙ্গে সঙ্গে সরকারও ৩০টি প্রতিষ্ঠানকে চাল আমদানির অনুমতি দিয়ে দিয়েছে বলে খবরে প্রকাশ। তথ্যাভিজ্ঞ মহল থেকে জানা যায়, আমনের মৌসুম শেষে বোরো চাষের মৌসুম শুরুর প্রাক্কালে বাজারে চালের সরবরাহ কিছুটা কম থাকে। ফলে দাম বাড়ার প্রবণতা সৃষ্টি হয়। এটাই নাকি বাজারের নিয়ম। সরকারের গুদামে এবং কৃষকের গোলা এ সময় আমন ধানে পরিপূর্ণ থাকলেও বাজারে সরবরাহ কম থাকার অজুহাতে দাম বেড়েছে।

এই নিয়ম যদি জানাই থাকে, তাহলে দুটি মৌসুমের মধ্যবর্তী সময়ে চাল আমদানি করার জন্য সরকার প্রতিবছর আগেভাগেই কেন ব্যবস্থা করে রাখে না! বাজারে চালের দাম বাড়ার পর সরকার যে আমদানির অনুমতি দিল, সেই আমদানির চাল বাজারে আসতে আসতে তো দাম আরও বাড়বে এবং মুনাফা যাঁদের করার তাঁরা তত দিনে তা করে ফেলবেন। সরকার কি তাহলে এই মুনাফা করার পরিবেশই তৈরি করতে চায়? না হলে তো দুই মৌসুমের মধ্যবর্তী সময়ে দাম বাড়ার আগেই চাল আমদানির ব্যবস্থা করে রাখতে পারে।

সরকার হয়তো একটি আদর্শ বাজার অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার জন্য বাজারের ওপর যখন-তখন নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে চায় না। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি, আমাদের দেশে সরকারের নিয়ন্ত্রণমূলক হস্তক্ষেপ এবং পদক্ষেপ ছাড়া বাজার স্বাভাবিক আচরণ করে না। কখনো করেনি। আমাদের বাজার সব সময় আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে আমরা বাজার অর্থনীতির একেবারে নাজুক অবস্থানে রয়েছি। আমাদের বাজারের যে আচরণ তা দেখলে বেচারা অ্যাডাম স্মিথেরও বোধ হয় মাথায় গোল বেঁধে যেত। কারণ এখানে চাহিদা এবং সরবরাহ দুই-ই সিন্ডিকেটের হস্তক্ষেপে নিয়ন্ত্রিত হয়। সুতরাং সরকারকেও এখানে নিয়ন্ত্রণমূলক হস্তক্ষেপ করতে হয়। কয়েক মাসের এ ধরনের নিয়ন্ত্রণমূলক সরকারি হস্তক্ষেপে কিছুটা হলেও সুফল ফলতে শুরু করেছে বলে দৃশ্যমান হচ্ছে। সরকারকে চেষ্টা করতে হবে এই ধারা অব্যাহত রাখার।

আমাদের জন্য আরেকটি বড় দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে আছে দেশের ব্যাংকিং খাত। দেশের অধিকাংশ ব্যাংক রুগ্‌ণ এবং ভগ্নস্বাস্থ্য। খেলাপি ঋণ এই ব্যাংক খাতের অতি পুরোনো একটি রোগ। এর সঙ্গে হাত ধরাধরি করে এসে যুক্ত হয়েছে অব্যবস্থাপনা। এই যে একটি ব্যাংক ফারমার্স ব্যাংক নাম নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হলো এবং রুগ্‌ণ হতে হতে যার অস্তিত্বই মিলিয়ে গেল, আবার পদ্মা ব্যাংক নাম নিয়ে নতুন বোতলে পুরোনো মদ চালানোর চেষ্টা করা হলো; কিংবা একটি পারিবারিক ব্যবসায়ী গ্রুপের হাতে সাতটি ব্যাংকের মালিকানা চলে গেল, কিন্তু ব্যাংকগুলো ভালোভাবে চলছে না, এগুলো তো দেশের আর্থিক খাতের ভয়ানক রোগগ্রস্থতা।

এই রোগের যথাযথ প্রতিষেধক প্রয়োগ করতে সরকার ব্যর্থ। ফলে রোগ আরও ছড়াচ্ছে। রোগের প্রকোপ আরও গভীর হচ্ছে। ব্যাংক খাতের রোগ সারাতে সরকার কয়েক মাসে কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে। কিন্তু ব্যাংকব্যবস্থায় বিদ্যমান অবস্থা দেশের আর্থিক খাতে যে নড়বড়ে অবস্থা তৈরি করেছে তার নিরসন করতে হলে কিছু লোকের শাস্তির ব্যবস্থা করা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।

দেশের অর্থনীতি ও অগ্রগতির ক্ষেত্রে আরেকটি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী বিষফোড়া হয়ে উঠেছে জ্বালানি খাত; বিশেষ করে প্রাকৃতিক গ্যাস। এই খাত নিয়ে সরকারকে আরও অনেক ভুগতে হবে। জাতিকে আরও অনেক দিন ভোগাবে জ্বালানি খাত; বিশেষ করে জ্বালানির দাম এবং চাহিদার তুলনায় সরবরাহস্বল্পতা। দেশের বিদ্যমান ক্ষেত্রগুলো থেকে গ্যাস উত্তোলন গত কয়েক বছরে কমতে কমতে দৈনিক ২ হাজার ৭৫০ মিলিয়ন ঘনফুটের স্থলে ২ হাজর থেকে ২ হাজার ১০০ মিলিয়ন ঘনফুটে নেমে এসেছে। এখন প্রান্তিক অবস্থায় পৌঁছানোর পর সরকার দেশের গ্যাস উত্তোলন বাড়ানোর লক্ষ্যে কিছু কাজ শুরু করেছে। কিন্তু তা দেশের শিল্প ও বিদ্যুৎ খাতের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ করতে আগামী পাঁচ বছরেও সক্ষম হবে বলে মনে হয় না। শুধু বাপেক্সনির্ভর অনুসন্ধান ও উত্তোলন বৃদ্ধির কার্যক্রম কাঙ্ক্ষিত ফল দিতে ব্যর্থ হতে বাধ্য। সমুদ্রবক্ষে অনুসন্ধানের যে পদক্ষেপ এত দিনে সরকার নিল তা থেকেও কমপক্ষে পাঁচ বছরের আগে কোনো ফল পাওয়া সম্ভব হবে না।

অন্যদিকে রয়েছে আমদানি করা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি)। বিশ্ববাজারে এখন এলএনজির দাম যথেষ্ট কম। এই দামে সরকার এখন আমদানি করতে সক্ষম। কিন্তু আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো (এফএসআরইউ) নেই। যে দুটি এফএসআরইউ রয়েছে তা ব্যবহার করে দৈনিক সর্বোচ্চ এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের সমপরিমাণ গ্যাস আনা সম্ভব। এর বেশি নয়। এর বেশি এলএনজি আমদানি করতে হলে নতুন যে অবকাঠামো করতে হবে তাতেও কয়েক বছর সময় লাগবে। সুতরাং দেশে গ্যাসের চাহিদা দৈনিক চার হাজার মিলিয়ন ঘনফুট ছাড়িয়ে গেলেও তিন হাজার মিলিয়নের বেশি সরবরাহ করা সম্ভব হবে না। দেশ গ্যাসের সরবরাহ ঘাটতির যে দুষ্টচক্রের মধ্যে পড়েছে, তা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া শিগগিরই সম্ভব হচ্ছে না।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

বার্তাজগৎ২৪

Link copied!