ঢাকা শনিবার, ১১ মে, ২০২৪

মূল্যস্ফীতির বিপদ ঠেকাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা অপরিহার্য

বার্তাজগৎ২৪ ডেস্ক

প্রকাশিত: মার্চ ২৪, ২০২৪

মূল্যস্ফীতির বিপদ ঠেকাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা অপরিহার্য

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতার প্রশ্নে কর্মকর্তারা এখন অনেক বাধার সম্মুখীন হন। বিশ্বের অর্ধেক মানুষ এ বছর নেতৃত্ব বাছাইয়ে ভোট দেবে। এমন পরিস্থিতিতে অপরিপক্ব হলেও সুদের হার কমানোর দাবি ক্রমশ জোরাল হচ্ছে এবং সামনের দিনে তা আরও বাড়তে থাকবে। সেই সঙ্গে ব্যাংকের সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং জনবল নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের ঝুঁকিও বাড়ছে। এসব চাপ সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্তাদের অবশ্যই মোকাবিলা করতে হবে।


কিন্তু এটা এত গুরুত্বপূর্ণ কেন, না হলে কী হবে? তাহলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীন সিদ্ধান্তের অর্জনগুলো নিয়ে আলোচনা করতে হবে। মহামারীর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা কার্যকরভাবে দায়িত্ব পালন করতে পেরেছেন। তখন তারা আগ্রাসীভাবে মুদ্রানীতি সহজ করতে পেরেছেন। এর ফলে আর্থিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেয়েছে বিশ্ব; অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে গতি এসেছে।


দ্রব্যমূল্যের স্থিতিশীলতার প্রয়োজন হলে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করতে পেরেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্তারা। তাতে নগদ অর্থের প্রবাহ কমে গিয়ে বাজারে প্রভাব পড়েছে। এ সময় জিনিসপত্রের দাম কয়েক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠলেও বেশির ভাগ দেশ মূল্যস্ফীতির হারকে প্রত্যাশার সঙ্গে সমন্বয় করতে পেরেছে। বিশেষ করে উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলো আগেভাগেই সংকোচনমূলক ও জোরালো পদক্ষেপ নিয়ে আস্থা অর্জন করেছে।


কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এসব কর্মকাণ্ড মূল্যস্ফীতির পাগলা ঘোড়ার লাগাম টেনে রেখেছে এবং অর্থনীতিকে বড় ধাক্কা থেকে রক্ষা করেছে। এই লড়াই এখনো চলছে। কিন্তু যতটুকু সফলতা এসেছে, তা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের অর্জিত স্বাধীনতা ও গ্রহণযোগ্যতার কারণেই সম্ভব হয়েছে।

মূল্যস্ফীতির লাগাম টানার সাম্প্রতিক সাফল্য ১৯৭০-এর দশকের চরম অর্থনৈতিক অস্থিরতার কালেও অর্জন সম্ভব হয়নি। কারণ, উচ্চ মূল্যস্ফীতির সেই কালে বাজারের স্থিতিশীলতাকে প্রাধান্য দেওয়ার ক্ষমতা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ছিল না; ছিল না স্বায়ত্তশাসন রক্ষায় কোনো আইন। সে কারণে উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যেও রাজনীতিবিদদের চাপের মুখে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার কমাতে বাধ্য হতো।

‘বুম অ্যান্ড বাস্ট এরা’ বা ফুলে ফেঁপে ওঠার পর অর্থনীতিতে বিপর্যয়ের কালে উচ্চ মূল্যস্ফীতির জন্য সবাইকে ভুগতে হয়েছিল। সীমিত আয়ের মানুষ তো বটেই। তাদের প্রকৃত আয় ও সঞ্চয় দ্রুত ফুরিয়ে যায়। কেবল আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে এসে মূল্যস্ফীতি বাগে আসে। কারণ মূল্যস্ফীতির বিরুদ্ধে কঠোর লড়াইয়ে ব্যাংকগুলো তখন রাজনৈতিক সহায়তা পেয়েছিল।

কিসে প্রভাব পড়ে, কীভাবে পড়ে
আইএমএফসহ অপরাপর সংস্থার বিস্তৃত গবেষণায় দেখা যায়, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত কয়েক ডজন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর গবেষণা চালিয়ে আইএমএফ দেখেছে, তুলনামূলক স্বাধীন কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী মূল্যস্ফীতির হার নিম্ন পর্যায়ে আটকে রাখায় সফল হয়েছিল। তাই সব আয়ের দেশই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতাকে আগের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।

লাতিন আমেরিকার ১৭টি ব্যাংকের ১০০ বছরের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে আরেকটি গবেষণা করেছিল আইএমএফ। তাতে সিদ্ধান্ত গ্রহণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতার পাশাপাশি সরকারকে ঋণ দিতে বাধ্য করার বিষয়টিও বিবেচনায় নেওয়া হয়। সেই গবেষণায় উঠে এসেছে, যেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যত স্বাধীন, সেখানে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে তত ভালো ফল মিলেছে।

সুতরাং মোদ্দা কথা হল— দ্রব্যমূল্যের স্থিতিশীলতার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা খুবই জরুরি। আর দীর্ঘ মেয়াদে ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য জরুরি দ্রব্যমূল্যের স্থিতিশীলতা।

কিন্তু গণতান্ত্রিক সমাজে ব্যাপক ক্ষমতার চর্চায় ভারসাম্য রক্ষার জন্য আস্থা অর্জনের বিকল্প নেই। আর তাই জোরাল সুশাসন, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং মূল দায়িত্ব পালন—এই চার বিষয় নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের প্রতিদিনই আস্থা অর্জন করতে হয়।

ব্যাংকিং খাতে জোরাল সুশাসন থাকলে মুদ্রানীতি নিয়ে স্পষ্ট আভাস পাওয়া যায়। তখন মুদ্রানীতিও স্বল্পময়াদি রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের লক্ষ্যে পরিচালিত না হয়ে দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হয়। কিন্তু এমন ব্যবস্থার জন্য সবার আগে দরকার দ্রব্যমূলের স্থিতিশীলতাকে মূল লক্ষ্য হিসেবে ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্য স্পষ্ট আইনি কাঠামো প্রণয়ন করা ।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে কর্মসংস্থানকেও কোথাও কোথায় জোর দেওয়া হয়। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক দুটি খাতই নিয়ন্ত্রণ করে। তবে আইনপ্রণেতারা এর মধ্যে বুঝে গেছেন, দ্রব্যমূল্যের স্থিতিশীলতা সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতায় সহায়ক হয়। তখন চূড়ান্ত ফলাফল হিসেবে স্বভাবতই কর্মসংস্থান বাড়ে।

তবে শুধু অধিকার পেলেই হবে না, কেন্দ্রীয় ব্যাংকারদের অবশ্যই জবাবদিহির আওতায় থাকতে হবে এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকাণ্ড বিধিবদ্ধ লক্ষ্য অর্জনে কীভাবে সহায়তা করবে, তা বিস্তৃত প্রতিবেদন ও আইনপ্রণেতাদের সামনে জবানবন্দি আকারে নিয়মিত তুলে ধরতে হবে। কারণ, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্ত সবাইকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। জনগণকে নীতিনির্ধারণী আলাপের অংশীদার করতে অর্থনৈতিক সাক্ষরতা বাড়ানোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকারের একযোগে কাজ করে যাওয়া উচিত।

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও আর্থিক ব্যবস্থাপনায় স্থিতিশীলতা বজায় রাখায় সফলতা ছাড়া আর কোনোভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা সরকার আস্থা অর্জন করতে পারে না।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিধিবদ্ধ লক্ষ্য অর্জনে ও পথের বাধা দূর করার ক্ষেত্রে সহায়তা করায় সরকারের অন্যান্য বিভাগের সুস্পষ্ট দায়িত্ব আছে। এ ক্ষেত্রে শুধু স্বাধীনতার আইন প্রণয়নই যথেষ্ট নয়, আইনের ভাষা ও মৌলিক চেতনাকেও মেনে চলতে হবে।

অর্থাৎ, অন্যান্য নীতি-কর্মকাণ্ড কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের কাজকে কীভাবে প্রভাবিত করে, সেটাও বিবেচনায় নিতে হবে।

সরকারি ঋণ পরিমিত মাত্রায় বেঁধে রাখার মতো উপযোগী বাস্তবানুগ রাজস্বনীতি কার্যকর করলে ‘ফিসক্যাল ডমিন্যান্স’ বা রাজস্ব আধিপত্যের ঝুঁকি কমবে। ফিসক্যাল ডমিন্যান্স হল- সরকারকে স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়ার জন্য ব্যাংকের ওপর চাপ, যার ফলে কার্যত মূল্যস্ফীতি বাড়ে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেওয়ার মতো আরেকটি দায়িত্ব সরকারের আছে। তা হল— শক্তিশালী ও সুনিয়ন্ত্রিত আর্থিক ব্যবস্থাপনা বজায় রাখা।

আর্থিক স্থিতিশীলতা থেকে সমগ্র অর্থনীতি লাভবান হয়। তখন সুদের হার বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সামনে আর্থিক বিপর্যয়ের শঙ্কা কাজ করে না। বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের পর উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান জোরদারে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল, তার ফলে আর্থিক ব্যবস্থার ক্ষতি না করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার বেশ বাড়াতে পেরেছিল। এই বড় অর্জন অবশ্যই ধরে রাখতে হবে।

আমরা দেখেছি, সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রত্যেকেই যখন নিজ নিজ ভূমিকা পালন করে, তখন মূল্যস্ফীতি থাকে সুনিয়ন্ত্রিত; প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানে সুফল মিলে; এবং আর্থিক স্থিতিশীলতায় ঝুঁকি একেবারে নিম্ন পর্যায়ে থাকে।

এসব লক্ষ্য অর্জনে সরকারকে সহায়তার জন্যই আইএমএফ কাজ করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতার ওপর আমরা সবচেয়ে বেশি জোর দিই। এ ক্ষেত্রে সুশাসন ও আইনি রূপরেখা উন্নত করায় সদস্য দেশগুলোকে আমরা লক্ষ্যাভিমুখী কারিগরি সহায়তা দিয়ে থাকি। আইএমএফসমর্থিত কর্মসূচিতে স্বাধীনতাকে বিশেষ ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়। সেক্ষেত্রে সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে ঐকমত্যের ভিত্তিতে স্বাধীনতার পরিমাপ ও তা অর্জনে পদক্ষেপ নিই।

স্বাধীনতা পরিমাপের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোকে নিয়ে সাম্প্রতিক এক জরিপের ভিত্তিতে আমরা নতুন পদ্ধতি প্রবর্তন করেছি। পাশাপাশি জবাবদিহিতা বাড়াতেও একটি বিধিমালা প্রণয়ন করেছি। ব্যাংকগুলোর নিজেদের চর্চার উন্নয়ন ও মূল্যায়নের কাজ সহজ করবে এটা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক, সরকারপ্রধান, আইনপ্রণেতা ও জনগণকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করার মাধ্যমে মূল্যস্ফীতির বিরুদ্ধে বিজয়ী হয়ে সামনের দিনগুলোতে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও প্রবৃদ্ধি বাড়ার লড়াইয়ে আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতকে শক্তিশালী করতে পারি। এতে সীমিত আয়ের মানুষ, ব্যবসা দাঁড় করাতে সচেষ্ট ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও মূল্যস্ফীতির পাগলা ঘোড়ায় নাভিশ্বাসের মধ্যে থাকা প্রতিটি সমাজ—সবার উপকার হবে।

মূল্যস্ফীতির বড় বিপদ যখন সামনে, তখন আমাদের অবশ্যই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা ধরে রাখতে হবে এবং তা জোরদার করতে হবে।

(লেখক: আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক-এমডি। সংস্থাটির ব্লগে প্রকাশিত ইংরেজি নিবন্ধ অনুবাদ করেছেন হুসাইন আহমদ)

বার্তাজগৎ২৪

Link copied!